একজন সংবাদকর্মী হিসেবে নিরবিচ্ছন্ন ইন্টারনেট আপনার প্রতিদিনকার সংবাদ সংগ্রহ এবং প্রেরণে কতটা জরুরী? কিংবা আদৌ জরুরী কিনা।
দেখেন ইন্টারনেট এখন ইন্টিগ্রেল পার্ট অফ আওয়ার লাইফ। আপনাকে যদি খুব দূরের কোনো স্থানে নিয়ে যাওয়া হয় যেখানে কিছুই নেই কিন্তু আপনার হাতে যদি ইন্টারনেট সংযোগ থাকে তবে আপনি দুনিয়ার সাথেই যুক্ত থাকতে পারবেন। কোনো সমস্যা হবেনা । এটা খুব বেসিক একটা জিনিস। কিন্তু সাংবাদিকদের জন্য এটা আরও জরুরী। কারন একদিকে তার প্রত্যেক মহুর্ত আপ টু ডেট থাকতে হয় আবার মানুষকে জানাতে হয় তথ্যগুলো। তার তথ্য সংগ্রহ করা থেকে পৌছে দেয়া পর্যন্ত ইন্টারনেট সুবিধার দরকার হয়। এবং পাশাপাশি তথ্যটাকে সংগ্রহ করার জন্যেও ইন্টারনেট লাগে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে গত ১০ বছরে একটা বিশাল পরিবর্তন এসেছে। মানুষের হাতে এখন স্মার্টফোন আছে এবং তারা যায় ইন্টারনেটে যুক্ত থাকতে।
আপনার ব্যক্তিগত কোনো অভিজ্ঞতার কথা মনে পরে যখন ইন্টারনেট না থাকার ফলে সমস্যায় পড়েছিলেন ?
হ্যাঁ, আছে তো। আপনাকে একটা উদাহরণ দেই। ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে কুমিল্লায় পূজা অনুষ্ঠানে একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে সংহিসতার শুরু হলো। সরকার এই ঘটনায় তাতক্ষনিক ইন্টারনেট সাসপেন্ড করে। যদিও আমরা অনেকক্ষন সেটা বুঝতেই পারিনি। ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় সমস্যা যেটা হলো- ঘটনার পরপর মিসইনফরমেশনগুলো খুব দ্রুত সামজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পরেছিলো। সেগুলো ফেসবুক-ইউটিউব থেকে গেলো। মানুষ পুরোনো এই মিসইনফরমেশনগুলোই বারবার দেখেছে। তথ্যের অবাধ প্রবাহ না থাকার ফলে রিয়েল টাইম ইনফরমেশনগুলো কিন্তু পৌছাতে পারলোনা। ফলে মানুষ এই ঘটনার একটা দিক জানলেন অপরটা জানতে পারলেন না। কারন ইন্টারনেট একসেস তো নেই। এই সময় মাইনরিটির উপরে হামলা হলো বিভিন্ন স্থানে। সবাই ভাবলো যে কেবল ইসলামের উপরেই অ্যাটাক হয়েছে। কিন্তু সে যদি পরবর্তী তথ্যগুলো জানতে পারতো, মানুষ নিজেই হয়তো তার আশেপাশে থাকা সংখ্যালঘুদের প্রোটেক্ট করতো। কিন্তু তার তো সুযোগ আর রইলো। এতে লাভের থেজে বরং যেটা হলো- ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়ার মধ্যে দিয়া মানুষের মনে একটা আশংকা তৈরী হলো যে হয়তো তাকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। গোপন কিছু হচ্ছে। তাই আমি মনে করি আপনি তথ্য প্রবাহকে যত বেশি সচল রাখবেন মানুষের কাছে তত বেশি সঠিক তথ্য পৌছাবে।
সম্প্রতি বিরোধী রাজনৈতিক দলের সমাবেশকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে একাধিক ইন্টারনেট শাটডাউনের ঘটনার কথা গণমাধ্যমে এসেছে। একজন সাংবাদিক হিসাবে আপনার বিশেষ কোনো অভিজ্ঞতার কথা শুনতে চাইবো।
অবশ্যই আছে। ১০ ডিসেম্বরের আগে বিএনপি যখন সমাবেশ করার ঘোষনা করলো। সহিংসতায় একজন মারাও গেলো। এরকম অবস্থায় যখন সমাবেশ শুরু হলো আমরা আগের দিন রাত থেকে সমাবেশস্থাল থেকে কোনো তথ্য সহজে প্রেরন করতে পারছিলাম না। ইনফ্যাক্ট একটা সাধারণ টুইট করার জন্যেও আমাদের হয়রান হতে হচ্ছিলো। সরকারের পক্ষ থেকে এটা বলা সহজ যে, অনেক মানুষ জমায়েতের ফলে এই সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের জন্য মানা খুব কঠিন। কারন ঢাকায় আরও সমাবেশ হয়েছে। সেখানে তো এরকম অভিযোগ চোখে পরেনি। তাছাড়া আমরা এরকম একটা জনবহুল শহরেই থাকি। বিএনপি বলছে তারা সাংবাদিকদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু সেটার দরকার ক্যানো হলো?
নেট শাটডাউন করে তথ্যের অবাধ প্রবাহ থামিয়ে দেয়ায় নাগরিক ও সাংবাদিকদের ক্ষতিটা কি হলো ?
ইন্টারনেট না থাকাটা একটা ভয়। আমি আপনাকে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলছি, বিএনপির বিভিন্ন সমাবেশে আমি লাইভ দেখার চেষ্টা করেছি । ইন্টারনেট না অতিমাত্রায় স্লো থাকার ফলে আমি পারিনি। ফলে আমি নিজেই তো শংকায় ছিলাম এখানে যদি কোনো দুর্ঘটনা হয়, সাবোট্যাজ হয় তাহলে কিভাবে তার ডকুমেন্টেশন করা হবে? হঠাৎ করেই দেখা গেলো যে , মির্জা বক্তব্য দিচ্ছে কিন্তু তার লাইভ নেই। তো এই কারনে আমি বলবো যে, ইন্টারনেটকে এভাবে বন্ধ করে দেয়া সাংবাদিকদের সঠিক তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে যেমন প্রতিবন্ধকতা তৈরী করে একই সাথে জনমনে ভীষণ বিভ্রান্তির জন্ম দেয়। ফলে একটা ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। আর আমাদেরও বেগ পেতে হয়।
ইন্টারনেট শাটডাউন যারা পরিমাপ করেন তাদের পরিসংখ্যানে গত কয়েক বছরে একাধিকবার নেট বন্ধের কথা উল্লেখ করা হয়েছে । এসব ঘটনায় সাংবাদিক বা নাগরিক হিসাবে উদ্বেগের কারন আছে কি ?
অবশ্যই আছে। এটা কেবল সাংবাদিকতার সমস্যা নয়। সংকটটা কিন্তু নাগরিকদেরই। কারন সাংবাদিক হিসাবে আমি যখন কাজ করছি, তখন তা আসলে নাগরিকদের জন্যেই করছি। তারা এই সংবাদ পড়বেন, দেখবেন সচেতন হবেন, বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত নেবেন। প্রত্যাশা হলো, সাংবাদিকদের কাজগুলোর মধ্য দিয়ে কোনো বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা তৈরী হবে। আমি যদি কোনো খবর, প্রতিবেদন তৈরি করলাম কিন্তু ইন্টারনেট সুবিধা না থাকার ফলে মানুষ এটা সময় মত পেলোনা, সংকটটা এখান থেকেই শুরু হয়। মানুষ তখন যা সামনে পায় তাই বিশ্বাস করতে শুরু করে। একটা উদাহরণ দেই, সাম্প্রদায়িক সংকটের সময় প্রায়ই দেখি যে ভারতের পুরোনো কোনো ঘটনার কোন ছবি বিভ্রান্তিকরভাবে ছড়ানো হচ্ছে। ছবির গুলোর পার্থক্য কই ? পার্থ্যক্য হলো সময়ে। একটা পুরোনো ছবি ভুল দাবীতে ছড়াচ্ছে। এর ফলে একটা সাম্প্রদায়িক সংঘাত আরও তিব্র হচ্ছে। অথচ তথ্যটা যদি সংবাদমাধ্যম আর ফ্যাক্টচেকাররা যাচাই করত পারতো সঠিক তথ্য দ্রুত মানুষের আছে পৌছে দিতে পারতো তাহলে হয়তো পরিস্থিতিই অন্য হত। কুমিল্লার ভায়োলেন্সটা যে সারাদেশে এমনকি ভারতেও ছড়িয়ে পরলো এর একটা কারন হলো ইন্টারনেট শাটডাউন। যে বাংলাদেশে আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে ইন্টারনেট বন্ধের মত ঘটনা ঘটবে না তার নিশ্চয়তা কিন্তু নেই। মানুষ এখন সামাজিক মাধ্যমের ব্যাপারে আরও আস্থাশীল হচ্ছে, সামনের সময়গুলো আপনি যদি তথ্যের অবাধ প্রবাহকে বজায় না রাখতে পারেন তবে তা বুমেরাং হবে।
মাঝেমাঝে বলা হয় যে ভুয়া তথ্যের প্রচার থামানোর জন্যেই ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়েছে। যুক্তি হিসাবে এটা কি খুব সঠিক?
দেখুন এখানে কিছু বিষয় মনে রাখতে। বাংলাদেশে মিসইনফরমেশনের একটা লম্বা ইতিহাস আছে। দেশের অনেক বড় বড় ঘটনার পিছনে দেখবেন ভুয়া তথ্যেই প্রধান ভুমিকায় ছিলো। মানুষ অনেক সময়ে এতে বিশ্বাসও করছে। ফলে আমরা যখন সাংবাদিকতা করছি তখন আমাদের এসব বিষয় মাথায় নিয়েই করতে হচ্ছে। কারন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এটাও তো সত্যি। এখান থেকেই কেউ কেউ ভাবতে শুরু করেছেন তথ্যের প্রবাহ আটকে দিলেই মনে হয় ভুয়া তথ্য ছড়ানো বন্ধ হয়ে যায়। এখান থেকে ইন্টারনেট বন্ধ করার ব্যাপারটা আসে। আমি এমনটা মনে করি না। আমি মনে করি সাংবাদিকদের যদি সঠিক খবর প্রচারের স্বাধীনতা দিলে বা তথ্যের অবাধ প্রবাহের সুযোগ চালু রাখলেই কেবল ভুয়া তথ্য থামানো সম্ভব। তথ্য প্রবাহ থামিয়ে দিয়ে নয়। আপনি গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করে, তথ্য প্রবাহ থামিয়ে দিয়ে বা কোনো ধরনের বিপরীত কন্ঠকে আটকে দিয়ে,আসলে আপনি কিছুই বদলাতে পারবেন না। এটাই বাস্তবতা। ভুয়া তথ্যের রেমেডি কেবল সঠিক তথ্যে, সব কিছু বন্ধ করে দেয়া নয়।
ইন্টারনেট শাটডাউন নিয়ে দুনিয়া জুড়ে সাংবাদিক এবং নাগরিক সমাজের মধ্যে তৎপরতা আছে। বাংলাদেশে সাংবাদিকরা কি এই বিষয়ে ওয়াকিবহাল?
সত্যি বলতে আমাদের এখানে খুব কম সচেতনতা আছে এই বিষয়ে। আমাদের এখানে ইন্টারনেট শাটডাউনের ঘটনা ঘটলে আমরা আন্তর্জাতিক রাইটস গ্রুপগুলো থেকে সেটা শুনতে পাই। সাংবাদিকরা অনেক সময় বুঝতে পারেন না যে এটা কতটা জরুরী। পাশাপাশি আরেকটা সমস্যা আছে তা হলো টেলিকম কোম্পানিগুলোর দিক থেকে। ঢাকায় আপনি যেই নেট স্পিড পান গ্রামে অনেক সময় সেটা পান না। অথচ আমরা উভয়ই নাগরিক। এসব বিষয়ে আসলে আপনাদের মত সংস্থাদের আরও কাজ করার প্রয়োজন আছে। কারন সাংবাদিকদের কাছে যদি ইন্টারনেট শাটডাউন সম্পর্কে বিস্তারিত জানাশোনা না থাকে তবে তারা যথাযথ রিপোর্টিং করতে পারবেনা। যেমন ধরেন সাংবাদিকদের কাছে বিটিআরসি একটা সোর্স। তারা কোনো একটা ঘটনায় বললো টেলিকম কোম্পানিদের ইন্টারনেট বন্ধ করতে। কিন্তু নিজেরা সেটা স্বীকার করলোনা। এ ধরনের ব্যাপার কিন্তু ঘটছে।
আবার ইন্টারনেট শাটডাউনের তথ্য মানুশকে জানানোর বিষয়ে বিভিন্ন পক্ষের দায়বদ্ধতাও তো আছে।
হ্যা দায়বদ্ধতার জায়গাটাও আছে। কিছু দিন আগে হওয়া বিএনপির সমাবেশের সময়ে আপনি দেখবেন, বিভিন্ন স্থানে ইন্টারনেট গতি কমিয়ে দেয়া হলো। টেলিকম কোম্পানিরা এটা অফ দ্য রেকর্ড স্বীকারও করলো। অথচ পুরোনো ঘটনাটা ঘটলো কোনো ট্রান্সপারেন্সি ছাড়া। পাবলিক ডোমেনে নেই। দেখুন, বিটিআরসির প্রশ্নটা ক্রেডিবেলিটির। আবার দায়বদ্ধতা তো টেলিকম কোম্পানিরও আছে। মানুষকে তো জানানো উচিত তাদের। হয়তো তারাও তো সাহস পাচ্ছেনা। এই সাহসটা আসে কোত্থেকে? যখন মুক্তমত আর গণতন্ত্রের চর্চাটা জারি থাকে। ইন্টারনেট অধিকারটা তাই সরাসরি গণতন্ত্রের সাথে যুক্ত।
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ইন্টারনেট শাটডাউনের ডকুমেন্টেশনের জন্য সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদনকে প্রধান একটি মানদন্ড বিবেচনা করে। কিন্তু বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে ইন্টারনেট বন্ধ থাকার খবরকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়া হয়না।
ডকুমেন্টেশনটা জরুরী নানান কারনে। অনেকে এটা বুঝতে চান না। ধরা যাক একটা শান্তিপূর্ন সমাবেশ শুরু হলো। আপনার কাছে সেই সমাবেশটা নিয়া শুরু হওয়া থেকে শেষ করা পর্যন্ত তথ্য থাকা জরুরী। কিন্তু আপনার কাছে যদি সেই তথ্য না থাকে, ইন্টারনেট বন্ধ করে কোনো ভুল তথ্য ছড়িয়ে দেয়া হয় তবে তার পরিনাম খুব ভালো হবার কথা না। আমার পরামর্শ হলো, ইন্টারনেট যে একটি অধিকার এই বিষয়ে নাগরিক সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। মিডিয়া, সিভিল সোসাইটি সকলের দায়িত্ব এটা। সংবাদমাধ্যমগুলোকেও আরও জানাবোঝা বাড়াতে হবে। তবে এটা সংবাদমাধ্যমের একার পক্ষে করা সম্ভব নয়। যেমন ধরা যায় বিএনপির সমাবেশের আগে যখন মানুষের মোবাইল চেক করা হচ্ছিলো, তখন অনেকেই আমাকে বলেছিলো- ‘ আরে দেখুক ভাই। কিছু তো পাবেনা।’ প্রশ্নটা তো কিছু থাকা না থাকার না। প্রশ্নটা হলো কারো ব্যক্তিগত ফোন বিশেষ অনুমতি ছাড়া কি যত্রতত্র চেক করা যায়? ফলে সচেতনতাটা গড়তে হবে আসলে আরও বড় পরিসরে। এক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমের দায়িত্ব আছে। তাদের এই বিষয়ে আরও জানাশোনা বাড়াতে হবে। আপনাদেরও অনেক কাজ আছে।