সাংবাদিকতা, তথ্য প্রবাহ ও ইন্টারনেট অধিকার

সাংবাদিকরা কাজ করে তথ্য নিয়ে। বর্তমানে তথ্যের সব থেকে বড় উৎস ইন্টারনেট। কমি বা অন্য জন্য হক। কিন্তু বাংলাদেশে দেখা যায়, বিভিন্ন ঘটনায় ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়ার ঘটনা ঘটে। একজন সাংবাদিক হিসাবে আপনার কাছে নিরবিচ্ছন্ন ইন্টারনেট সুবিধা কতটুকু জরুরী বা আদৌ জরুরী কিনা।

আমার মনে হয়না তথ্য প্রবাহকে বাঁধাগ্রস্ত করে বা সংকুচিত করে কোনো ন্যাশন বা সরকারের লাভ হয়। এতে যেটা হয়, আরও রিউমারটা বাড়ে। সম্প্রতি যেটা হয়েছে বান্দরবানের কিছু জায়গায় বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী ক্রাকডাউন করছে কেএনএফ নামের একটি সশস্ত্র গোষ্ঠির উপর অভিযান চালিয়েছে। আইএনএফ কারা? এরা একটা ইনসার্জেন্ট গ্রুপ যারা স্বায়ত্তশাসন চায়। এমন কথা পত্রিকা মারফত শোনা যাচ্ছে। ওরা চায় যে ওখানে তাদের একটা অটোনমি প্রতিষ্ঠিত হোক। তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের নানান অভিযোগ আছে, একটা হলো তারা এক্সট্রিমিস্টদের ট্রেইন করছে। কথা হলো কি, এটা করতে গিয়ে সরকার যখন গতমাসে ক্রাকডাউ করলো তখন পুরো এরিয়ার ইন্টারনেটকে বন্ধ করে দেয়া হলো। ফলে আমাদের এখানে আমরা কেউ কোনো তথ্য পাচ্ছিলাম না। মানে খবরের একটা ব্ল্যাক আউট। কী আসলে হচ্ছে ওখানে, কোন হিউম্যান রাইটস ভায়োলেশন হচ্ছে কিনা। স্থানীয় লোক গুলো কেমন আছে, তাদের কোনো বেসিক নিডস পুরোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা- আমরা কিছুই জানতে পারিনি। অথচ সাংবাদিকদের কাজ হলো তথ্যগুলো মানুষের থেকে নিয়ে মানুষের কাছে তুলে ধরা। ধরেন সেখানে কেএনএফ আছে। কিন্তু সেখানে তো প্রচুর সাধারণ মানুষও থাকে। তারা ক্যানো ডিসপ্রপশনাটলি এফেক্টেড হবে?

 ফলে তথ্যটাকে আটকে দিয়েআসলে কার লাভ হচ্ছে?  পরে যেটা হলো যে, আমরা দেখলাম যে স্থানীয় সেই লোক গুলো হেটে ইন্ডিয়ায় চলে গেছে। তিনদিন ধরে হেঁটে গিয়েছে তারা।  তারা ঐ খানে গিয়ে অনেকগুলো ভয়াবহ অভিযোগ করেছে। তারা সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে তারা মিলিটারির বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে। এরমধ্যে এরকম অভিযোগ আছে তারা তিন দিন ধরে কিছু খেতে পায়নি। না খেয়ে ছিল। তারা ঘর থেকে বের হলেও বিভিন্ন ভাবে নির্যাতিত হচ্ছিল বলেও অভিযোগ জানাচ্ছে৷

 তো যেটা হয়েছে আমরা এই তথ্যগুলো কে আটকে রেখে তো কিছুই আটকে রাখতে পারিনি সবকিছুই প্রকাশ হলো। কিন্তু ইন্টারনেট বন্ধ করে বা তথ্য আটকে রাখার ফলে যেটা হয়েছে এটা নিয়ে প্রচুর পরিমাণে স্পেকুলেশন হয়েছে, রিউমার হয়েছে। ওখানে কি ধরনের ঘটনা ঘটছে এসব প্রকৃত কেউ কিছু জানে না।

ফলাফলে আমরা যেটা দেখলাম যে তথ্যের প্রবাহকে বন্ধ করে দেয়া হলো বাধাগ্রস্থ করা হলো কি সত্যিকার অর্থে তথ্যগুলোকে আটকে রাখতে পারা গেলো ? না।

তো এতে সত্যিকার অর্থে আমার কতটুকু হেল্প হলো এটা আমাদের ভাবা দরকার। ইনসারজেন্টরা তো বিভিন্ন উপায়ে যোগাযোগ করতে পারে। কেবল ইন্টারনেট বন্ধ করে তাদের থামানো যাবে কিনা এটা বড় প্রশ্ন।  সরকারের ধারণা ছিলো – আমি ক্রাকডাউন করলাম   এবং আমি ইন্টারনেটকে বন্ধ রাখি তাহলে হয়তো আমাদের অভিযানটা সাকসেসফুল হলো। কিন্তু এই ড্রাইভ টা কি আদৌ সাকসেসফুল হল? আমরা দেখলাম ছয় সাতশ জন মানুষ না খেয়ে সিমান্ত পারি দিয়ে আরেক দেশে গিয়া নিজ দেশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলো। এতে করে যেটা হলো, এধরনের কাজের মাধ্যমে দেশকে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিটিসিজমের মুখে পড়তে হলো। এবং এটা কিন্তু একমাত্র ঘটনা ন। এটা কিন্তু অনেক জায়গায় ঘটতেছে।  বিএনপি’র ডিভিশনাল সমাবেশগুলো হলো প্রায় সবগুলো বিভাগেই কোনো না কোনোভাবে নিরবিচ্ছিন্ন ইন্টারনেট প্রবাহ বাধা প্রাপ্ত হয়েছে । এর ফলে যেটা হচ্ছে কোন ছবি আসছে না বা তাৎক্ষণিক অনেক সময় সংবাদ প্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। বলা চলে পুরো একটা শনিবারই মানুষের ভয়ার্ত অবস্থায় যাচ্ছে।

এভাবে ইন্টারনেট সুবিধা বাধাগ্রস্ত হওয়ায় ক্ষতি হলো কি কি?

অনেক অনেক ধরণেরর ক্ষতি হলো৷ অর্থনৈতিক দিকটা ছেড়ে কেবল অধিকারের দিকটা বলি। বরিশালে কী হচ্ছে বা খুলনায় কী হচ্ছে বা রংপুরে কী হচ্ছে কেউ জানেনা৷ তথ্য পাচ্ছেনা– যা মানুষকে একটা শঙ্কার মধ্যে ফেলে দিচ্ছে।  এমন কিন্তু নয় যে এটা কোন অবৈধ কাজ। ফ্রিডম অ্যাসেম্বলি বা সমাবেশ করার অধিকার এটা কিন্তু আমাদের ডেমোক্রেটিক রাইট। আমরা যদি এই ডেমোক্রেটিক রাইট পালনে বাধা দেই তাহলে সেটা তো কর্তৃত্ববাদী আচরণ হলো। ফলে তথ্যের অবাধ প্রবাহকে বাধাপ্রাপ্ত করে কোন সরকার বা রাষ্ট্রের লাভ হয়না। হয়েছে বলেও আমার জানা নেই।

কিন্তু কখনো কখনো ইন্টারনেট শাটডাউন করার পিছনে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা কমিয়ে আনার কথাও বলা হয় কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে।

কিছু কিছু ক্ষেত্রে যেমন ধরুন, মাইনোরিটি রায়টের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি ইনিশিয়াল ফিয়ারটা যখন ছড়িয়ে পড়ে তখন ইন্টারনেট সুবিধাকে কিছুটা সময়ের জন্য কমিয়ে আনা হয়তো কাজে লাগতে পারে এরকম বলা হয়। তবে আমি সত্যি বলতে এটাও যে অনেক কাজে লাগে আমার মনে হয় না। আমাদের স্ট্যাটিসটিক্স কিন্তু এটা বলছে না। যেটা আমরা রামুর ক্ষেত্রে দেখছি, গতবছর কুমিল্লা, চাঁদপুরের ক্ষেত্রে দেখছি। ইন্টারনেট তো অফ হলো কিন্তু মানুষ থেকে মানুষ ছড়িয়ে পরলো। তাকে থামানো গেলোনা৷

আপনার ব্যক্তিগত আপনার অভিজ্ঞতা কি বলছে?  তথ্যের প্রবাহ থামিয়ে কি পরিস্থিতি শান্ত হয়?

আমি মনে করি এতে উলটো ফল হয়। ক্ষতি হয়।  ক্ষতি যেটা হয় আমরা সঠিক তথ্য দিতে পারিনা।  মানুষ তখন সঠিক তথ্য জানতে পারেনা। ধরুন কোনো একটা ইলেকশনের দিন ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া হলো৷ তাতে মানুষ সঠিক তথ্য পেলো না। মানুষের মধ্যে এক ধরনের শংকা তৈরি হলো। ইন্টারনেট বন্ধ করা মানেই হলো ভীতির পরিবেশ তৈরী করা। তখন রিউমারগুলো আরও দ্রুত ছড়ায়। যেমন গত বছর কুমিল্লার উত্তজনার মাঝে আমরা একটা তথ্য চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ থেকে। দাবি করা হলো একটা শিশু ধর্ষিত হয়েছে। তথ্যটা তাৎক্ষনিক যাচাই করা খুবই জরুরী ছিলো। আমরা নিশ্চিত হলাম এটা রিউমার। পরে ফ্যাক্টচেকাররা এটা ভুয়া চিহ্নিত করলো। কিন্তু ইন্টারনেট বন্ধ থাকার ফলে মাঝের যে সময়টা এই ভুয়া তথ্যকে কেন্দ্র করে ভারতের ত্রিপুরা বা আশেপাশের এলাকায় মুসলিম বিরোধী রায়ট তৈরী হয়ে গেলো।  

কিন্তু আমরা রিউমারটা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পরার সাথে সাথেই যদি চাঁদপুরের সেই জায়গায় কমিউনিকেট করতে পারতাম। বা আন্তর্জাতিক আউটলেটগুলোতে নিউজ করতে পারতাম যে এরকম কিছু ঘটেনি, তাহলে হয়তো ভারতের সহিংসতাটা এড়ানো যেন। কিন্তু কিভাবে পারবো? ওখানে তো ইন্টারনেট বন্ধ তখন। ফলে আমরা তাৎক্ষনিক একশন করতে করতে পারিনি।এসব দিক থেকে আমার মনে হয় এই ইন্টারনেট বন্ধ করাটা কাউন্টার প্রোডাক্টিভ।

সত্যি বলতে আমি দেখছি,  যখনি ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়- ইট ক্রিয়েট আ ক্লাইমেট অফ ফিয়ার। তথ্যের অবাধ প্রবাহ হলো বাতাসের মত, আলোর মত। ধরেন সূর্যের আলো যদি কখনো মেঘ দ্বারা ঢেকে যায় বা হুট বন্ধ হয়ে যায় আপনার মনে শংকা তৈরী হবে। ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়াও সেরকম। এতে যে কোনো দেশের সরকার খুব বেনিফিটেড হয় এরকম কোনো স্ট্যাটিটিক্স আমার চোখে পরেনি।

প্রত্যেকটা দেশে ইন্টারনেট ফ্রিডম বা ডিজিটাল রাইটসকে প্রোটেক্ট করার ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের তৎপরতা দেখা যায়। এখানকার সাংবাদিকদের মধ্যে থেকে এসব অধিকারের সপক্ষে কোনো তৎপরতা আছে কিনা।

আমাদের এখানে তেমন তৎপরতা নেই বললেই চলে। আপনি প্রচুর এরকমের ঘটনা দেখবেন যে আমাদের এখানে ইন্টারনেট শাটডাউন হয়েছে। আমরা নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় দেখছি, বা কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় দেখেছি। এখনো বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশে লাগাতারে হলো। বাংলাদেশে এটা নিয়ে খুব সিরিয়াসলি ভাবা হয়নি। বাংলাদেশে দুইটা স্কুল অফ থট আছে। একধরনের জার্নালিজমে আপনি দেখবেন কিছু কিছু নিউজ একদম ব্ল্যাকআউট করা হচ্ছে। ধরে নেয়া হয় ব্ল্যাক আউট করলে হয়তো ভায়োলেন্সটা থেমে যাবে। যেমন আপনাকে একটা উদাহরণ দেই। আমাদের এখানে এন্টি-মাইনরিটি রায়টে আপনি দেখবেন কেউ মারা গেলো তাদের ধর্মটা ডেলিবারেটলি প্রকাশ করা হয়না। আবার অনেক সময় তো রিলিজিয়াস রায়টের নিউজই প্রকাশ করা হয়না।

ভয়ে থাকে যে, এটা হয়তো উত্তেজনাকে আরও বাড়াবে। কিন্তু এই সেলফ সেন্সরশিপ আসলে কাজে আসে না।

তেমন ডিজিটাল রাইটস বা ইন্টারনেট রাইটস নিয়ে যারা কাজ করছেন তারা জানেন, সাংবাদিকরা এটা নিয়ে ওয়াকিবহাল না। কেউ কেউ শাটডাউনকে সমর্থনই করে বসেন। আমার মনে হয় তাদের সাথে আলাপ করা যেতে পারে। আপনারা তাদের সাথে ডায়লগের রাস্তা তৈরী করবেন৷

সাংবাদিকতার অন্য ধারাটি হলো সুবিধাভোগী। ক্ষমতার সুবিধাভোগী কিছু সাংবাদিক আসলে সব সময় থাকেই। তারা সবকিছুই জাস্টিফাই করতে চায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে যেটা হয়, পাবলিক ট্রাস্টটা নষ্ট হয়ে যায়। অবাধ তথ্যের প্রবাহ যে কতটা জরুরী সেটা হাজীগঞ্জের ঐ ঘটনা থেকেই বুঝতে পারি। এটা অনেকে এখনো বুঝতে চাননা। তথ্যের প্রবাহ যদি ঠিক থাকতো বা আমরা সময় মত যদি জানাতে পারতাম যে এটা ধর্ষণের তথ্যটি সঠিক নয়, তাহলে হয়ত ভারতের মুসলিম বিরোধী রায়ট হতই না।

লম্বা সময় ধরে তথ্য নিয়ে কাজ করার পর বর্তমান সময়ে আপনার কাছে ইন্টারনেটের স্বাধীনতা কতটা জরুরী মনে হয় ?

বলে শেষ করা যাবেনা, ইন্টারনেট থাকাতে আমরা কতভাবে ইনফর্মড হয়েছি! প্রতিনিয়ত লাভবান হচ্ছি। ধরা যাক ইন্টারনেট নেই। তখন আপনার একমাত্র সূত্র হলো কিছু পত্রিকা, ম্যাগাজিন আর রাষ্ট্রীয় প্রচারপত্র। কিন্তু ইন্টারনেট থাকায় আপনি প্রতিটা মুহুর্তে তথ্যের সাথে থাকতে পারছেন। নানান মতের সাথে আপনার পরিচয় হচ্ছে। এটা এখন একটা মুক্ত বাতাসের মতো, সূর্যের আলোর মতো হয়ে গেছে। অনেক ক্ষেত্রে ইন্টারনেট স্বাধীনতা ছাড়া আপনি মানবাধিকারই প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন না।

আপনার আলোচনায় বিগত সময়ে ইন্টারনেট প্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হওয়া নিয়ে উদ্বেগ উঠে এসেছে। আগামির সময়ে সাংবাদিক বা সিভিল সোসাইটি থেকে আপনি নিরবিচ্ছন্ন ইন্টারনেট প্রবাহ নিশ্চিত করতে কেমন তৎপরতার আশা করেন ?

আমাদের এখানে ফ্রিডম অব স্পিচের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। ফলে একটা বিশ্বাসহীনতা আছে নাগরিকদের মধ্যে। সকল খবর প্রকাশও এখানে কখনো কখনো বাধাপ্রাপ্ত হয়। এর ফলে এখানে একটা নাগরিক সাংবাদিকতারও উদ্যোগ আছে। এসব কিছুর জন্যই নিরবিচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সুবিধা অত্যন্ত জরুরী। এরকম একটা অবস্থায় সচেতনভাবে যদি সরকারের তরফ থেকে ইন্টারনেট শাটডাউনের ঘটনা ঘটে তবে সরকার আর তার জনগনের মধ্যে বিশ্বাসের সেতুটি ভেঙ্গে পড়বে। জনগন মনে করবে সরকার তার থেকে দূরের কোনো জিনিস। নিজের নয়। এটা কোনো সমাজের জন্য ভালো খবর নয়।  কোনো পক্ষের জন্যেই কাম্য নয়। এটা থেকেই বিশ্বাসহীনতা এবং শেষে ভায়োলেন্স তৈরী হয়। ফলে আমাদের এই বিশ্বাসের জায়গাটি তৈরী করতেই অবাধ ইন্টারনেট প্রবাহের পক্ষে দাঁড়াতে হবে। এটা আমার আপনার সবার দায়িত্ব।

সাংবাদিকরা কাজ করে তথ্য নিয়ে। বর্তমানে তথ্যের সব থেকে বড় উৎস ইন্টারনেট। কিন্তু বাংলাদেশে বিভিন্ন ঘটনায় ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনা ঘটে। আপনার কাছে নিরবিচ্ছন্ন ইন্টারনেট সুবিধা কতটা জরুরী বা কিভাবে?

আমার মনে হয়না তথ্য প্রবাহকে বাধাগ্রস্থ করে বা সংকুচিত করে কোনো সরকারের লাভ হয়। এতে যেটা হয়, রিউমারটা আরও বাড়ে। সম্প্রতি বান্দরবানের কিছু জায়গায় বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী কেএনএফ নামের একটি সশস্ত্র গোষ্ঠির উপর অভিযান চালিয়েছে। কেএনএফ কারা? এরা একটা ইনসার্জেন্ট গ্রুপ– যারা স্বায়ত্তশাসন চায়, এমন কথা পত্রিকা মারফত শোনা যাচ্ছে। ওরা চায় যে, ওখানে তাদের একটা অটোনমি প্রতিষ্ঠিত হোক। তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের নানান অভিযোগ আছে, একটা হলো তারা এক্সট্রিমিস্টদের ট্রেইন করছে। কথা হলো কি, এটা করতে গিয়ে সরকার যখন গতমাসে ক্রাকডাউন করলো তখন পুরো এরিয়ার ইন্টারনেটকে বন্ধ করে দেয়া হলো। ফলে আমাদের এখানে আমরা কেউ কোনো তথ্য পাচ্ছিলাম না। মানে খবরের একটা ব্ল্যাক আউট। কী হচ্ছে ওখানে, কোন মানবাধিকার লংঘন হচ্ছে কিনা, স্থানীয় লোকগুলো কেমন আছে, তাদের কোনো বেসিক নিডস পূরণে সমস্যা হচ্ছে কিনা আমরা কিছুই জানতে পারিনি। অথচ সাংবাদিকদের কাজ হলো তথ্যগুলো মানুষের থেকে নিয়ে মানুষের কাছে তুলে ধরা। ধরেন সেখানে কেএনএফ আছে। কিন্তু সেখানে তো প্রচুর সাধারণ মানুষও থাকে। তারা কেন ডিসপ্রপোশনেটলি এফেক্টেড হবে? অথচ তারেই বিপদে পড়েছে।

তথ্যের এই অবাধ প্রবাহকে আটকে কি খুব লাভজনক কিছু পাওয়া গেলো?  বা এর ফলে ক্ষতি কি হলো?

আমি তো মনে করি কোনো প্রাপ্তি নেই। তথ্যটাকে আটকে দিয়ে আসলে কার লাভ হচ্ছে? বান্দরবানের ক্র‍্যাকডাউনের ঘটনায় যেটা হলো, আমরা দেখলাম ক্রাকডাউন চলাকালে স্থানীয় সেই লোকগুলো হেঁটে ইন্ডিয়ায় চলে গেছে। তিনদিন ধরে হেঁটে গিয়েছে তারা। সেখানে গিয়ে অনেকগুলো ভয়াবহ অভিযোগ করেছে। তারা সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে, মিলিটারির বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে। এরকম অভিযোগও আছে যে, তারা তিন দিন ধরে কিছু খেতে পায়নি। না খেয়ে ছিল। তথ্যের আদান প্রদানও করতে পারেনি। তারা ঘর থেকে বের হলেও বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হচ্ছিল বলেও অভিযোগ জানাচ্ছে৷ তো, এই তথ্যগুলোকে থামিয়ে রেখে তো কিছুই আটকে রাখতে পারা যায়নি। সবকিছুই তো প্রকাশ হলো। আবার ইন্টারনেট বন্ধ করে বা তথ্য আটকে রাখার ফলে বান্দরবানে কী ঘটনা ঘটছে তা নিয়ে প্রচুর পরিমাণে স্পেকুলেশন হয়েছে, রিউমার হয়েছে। তথ্যের প্রবাহকে বন্ধ করে দিয়ে বা বাধাগ্রস্থ করে কি সত্যিকার অর্থে তথ্যগুলোকেও আটকে রাখতে পারা গেলোনা। এতে সত্যিকার অর্থে আমাদের লাভ হলো কিনা আমাদের ভাবা দরকার। ইনসারজেন্টরা তো বিভিন্ন উপায়ে যোগাযোগ করতে পারে। কেবল ইন্টারনেট বন্ধ করে তাদের থামানো যাবে কিনা এটা বড় প্রশ্ন। বরং এসব ক্ষেত্রে জনসাধারণকেই মূল্য শোধ করতে হয়।

আমরা যদি বান্দরবানের ঘটনাটি ধরেই প্রশ্ন করি- এক্ষেত্রে সরকারের মনভাবটা আসলে কি? ফলাফলে আমরা কি পেলাম?

সরকারের ধারণা ছিলো– আমি ক্রাকডাউন করলাম  এবং আমি ইন্টারনেটকে বন্ধ রাখি তাহলে হয়তো আমাদের অভিযানটা সাকসেসফুল হবে। কিন্তু এই ড্রাইভটা কি আদৌ সাকসেসফুল হলো? আমরা দেখলাম ছয়-সাতশ’জন মানুষ না খেয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আরেক দেশে গিয়ে নিজ দেশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলো। এতে করে দেশকে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিটিসিজমের মুখে পড়তে হলো। এবং, এটা কিন্তু একমাত্র ঘটনা না। এটা অনেক জায়গায় ঘটছে। বিএনপি’র ডিভিশনাল সমাবেশগুলোর প্রায় সবগুলো বিভাগেই কোনো না কোনোভাবে নিরবিচ্ছিন্ন ইন্টারনেট প্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে । এর ফলে যেটা হচ্ছে কোন ছবি আসছে না বা তাৎক্ষণিক অনেক সময় সংবাদ প্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। বলা চলে প্রতি শনিবারই মানুষের ভয়ার্ত অবস্থায় গিয়েছে।

লেখক

সাংবাদিক ও রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

প্রাসঙ্গিক লেখা

Activate Rights. All rights reserved.